">
জীবনে কোন কিছু করার ইচ্ছা থাকলে একদিন সফলতা আসবেই তার সার্থক উদাহরণ কুনবের সচদেবা। বিশ্ব জুড়ে আজ তাঁর নামডাক। তাঁর নামের আগে বসে গিয়েছে ‘ইনভার্টার ম্যান অব ইন্ডিয়া’ শব্দটা।
একসময় পেট চালাতে কলম আর স্টেশনারি আইটেম বিক্রি করতেন। কিছুদিন একটা কমিউনিকেশনস কোম্পানিতে সেলস ডিপার্টমেন্টেও কাজ করেছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বারবার পথ বদলেছেন। অবশেষে পেয়েছেন ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ। ইয়োর স্টোরিতে আজ সেই কুনবেরের উত্থান কাহিনি।
দিল্লির এক মধ্যবিত্ত পাঞ্জাবি পরিবার থেকে উঠে আসা কুনবেরের ছেলেবেলা কেটেছে সাধারণভাবেই। বাবা-মা আর তাঁরা তিনভাই। ভারতীয় রেলে কেরাণির চাকরি করতেন বাবা, মা গৃহবধূ। কুনবেরের প্রাথমিক পড়াশোনা একটি প্রাইভেট স্কুলে শুরু হলেও অর্থের অভাবে তাঁকে পরে ভর্তি হতে হয় একটি সরকারি স্কুলে। পড়াশোনায় খারাপ ছিলেন না। কিন্তু দু’দুবার চেষ্টা করেও মেডিক্যালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় আটকে যান। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় পড়ার সুযোগ এসেছিল। কুনবের আবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আগ্রহী ছিলেন না। শেষপর্যন্ত হিন্দু কলেজে স্ট্যাটিক্সটিক্স অনার্স নিয়ে ব্যাপারটা মিটেছিল।
কেবল টিভির ব্যবসা
বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে বরাবরই উৎসুক ছিলেন কুনবের। কলেজে পড়ার সময় তাঁর সেই আগ্রহ বহুগুণ বাড়ে। যা কিছু একটা পেলেই হল। গোগ্রাসে পড়ে ফেলতেন কুনবের। পরে এই পড়াশোনা তাঁর খুবই কাজে এসেছিল। বিশেষ করে যখন তিনি ইনভার্টার ব্যবসায় পা রাখেন। এইসময় বই-খাতা-পেনের একটা ব্যবসা শুরু করেন কুনবেরের ভাই। সংসার চালাতে তাতে হাত লাগান কুনবেরও। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করার পরে জীবনের প্রথম তথা শেষবার একটি চাকরিতে যোগ দেন কুনবের।
একটি কমিউনিকেশনস কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ। সেখানে কাজ করতে গিয়েই এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উপলব্ধি করেন কুনবের। ১৯৮৮ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েই দিল্লিতে নিজেই খুলে ফেললেন কেবল বিজনেস। নাম দিলেন সু-কম কমিউনিকেশন সিস্টেমস (Su-Kam Communication Systems). সেলসে পারদর্শিতা থাকলেও কেবল ব্যবসার প্রযুক্তি বিষয়ে সড়গড় ছিলেন না কুনবের। কিন্তু বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়েই ব্যাপারটা বুঝে নেন তিনি। যন্ত্র বসাতে তিনি নিজেই চলে যেতেন গ্রাহকের বাড়িতে। হাতেকলমে সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও বদলে দেয়। পেয়ে যান প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস।
কুনবেরের কপালও চওড়া ছিল। সেই সময় ঘরে-ঘরে কেবল টিভি বসানোর ধুম। কাজ সামলে ওঠাই দায়। নিজের পড়াশোনাকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিগত দিকটা আরও ভালোভাবে বুঝে নেন কুনবের। নিজেই ট্রেনিং দিতে শুরু করেন তাঁর কর্মীদের। একইসঙ্গে শুরু করেন কেবল টিভির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উৎপাদন। তৈরি করতে শুরু করেন ডিরেকশনাল কাপলার, অ্যাম্পলিফায়ার, মডুলেটরস। বিশেষ জোর দেওয়া হয় স্পেকট্রাম অ্যানালাইজার তৈরিতে।
ইনভার্টারের দুনিয়ায়
কেবল ব্যবসা খুবই ভালো চলছিল। কিন্তু সেই কেবল ব্যবসাও একদিন ছেড়ে দিলেন কুনবের। সেও এক চমকপ্রদ গল্প। কুনবেরের বাড়ির ইনভার্টার মাঝেমধ্যেই গণ্ডগোল করত আর ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে আনা হত। আসলে সেই সময়ে ইনভার্টারের মান ভালো ছিল না। গোড়ায় গণ্ডগোলের সেই ব্যাপারটা মাথায় নেন কুনবের।
একদিন নিজেই খুলে ফেললেন একটা ইনভার্টার। দেখলেন সেখানে লাগানো রয়েছে নিম্নমানের পিসিবি বোর্ড। নব্বইয়ের দশকে সেই সময় বাজার চলতি যে সব ইনভার্টার মিলত, তা একে-একে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল সু-কমের কেবল টিম। সবেতে একই রোগ। খারাপ মানের যন্ত্রাংশ।
ভালো জিনিস কেমন হয় তা বুঝতে কানাডা থেকে আনা হল অত্যাধুনিক ইনভার্টার। বোঝা গেল ফারাকটা। বেশকিছু পরীক্ষানিরীক্ষার পরে ইনভার্টার তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন কুনবের। ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করল তাঁর Su-Kam Power Systems. কিন্তু কী হবে তাঁর কেবল টিভির যন্ত্রাংশ তৈরির ব্যবসার?
ইনভার্টারের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে সেই ব্যবসায় ইতি টানলেন কুনবের। কেবল টিভির ব্যবসা থেকে পুরো টিমটাকেই সরিয়ে আনলেন সু-কম পাওয়ার সিস্টেমসে। শুরু হল ইনভার্টার, ইউপিএস তৈরির কাজ। প্রথম দিকে সেইসব জিনিস সরাসরি বিক্রি করা হত। কিন্তু এই পথে খুব বেশিদূর এগনো সম্ভব নয় বুঝে ডিলার-ডিস্ট্রিবিউটর নেটওয়ার্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেন কুনবের। যে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়েছিল।
ব্যবসার মারপ্যাঁচ
সে সময় বাজার চলতি যে সব ইনভার্টার মিলত আকারে বেশ বড়সড় ছিল। সেই তুলনায় সু-কমের ইনভার্টার ছিল এর এক-চতুর্থাংশ। ফলে ডিস্ট্রিবিউটরদের এর কার্যকারিতা বোঝাতে কালঘাম ছুটতে লাগল কুনবেরের। প্রযুক্তির দিক থেকেও সু-কমের ইনভার্টার ছিল বেশ এগিয়ে। দেখতেও সুন্দর।
একসময় ডিস্ট্রিবিউটররা বুঝতে পারলেন এর কার্যকারিতা। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাজারের চাহিদার কথা মাথায় রেখে জেনারেটর, এয়ার কন্ডিশনারের জন্যও ইনভার্টার বানাতে শুরু করেন কুনবের। ২০০০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রথম সংস্থা হিসাবে প্লাস্টিক বডির ইনভার্টার তৈরি করে সু-কম। ইলেকট্রিক শক থেকে মানুষকে বাঁচাতেই এমন উদ্যোগ। প্রথম প্লাস্টিক বডির ইনভার্টার ‘চিক’ (Chic) সেইসময় দশকের সেরা আবিস্কারের শিরোপা পায়।
কুনবেরের চ্যালেঞ্জ
নব্বইয়ের দশকে ভারতে স্টার্টআপ ব্যাপারটাই অজানা ছিল। বড়-বড় কোম্পানির সুরক্ষিত চাকরি ছেড়ে প্রায় কেউই শুরুয়াতি সংস্থার অনিশ্চিত নৌকায় উঠতে রাজি ছিলেন না। কাজের জন্য দক্ষ কর্মী পাওয়া এক বড় সমস্যা। তবে হাল ছাড়েননি কুনবের। কর্মীদের নিজের উদ্যোগেই প্রশিক্ষিত করেছেন, তাদের উৎসাহিত করেছেন এবং নিজের সংস্থায় ধরে রেখেছেন। আসলে নতুন কিছু তৈরি করা মানেই ধারাবাহিক পরীক্ষানিরাক্ষা আর ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া। সেইসময় কর্মীদের মনোবল ধরে রাখাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এর ওপর ছিল লগ্নির সমস্যা।
আনকোরা একটা সংস্থায় টাকা ঢালতে কেউই রাজি ছিলেন না। এমন কোনও বিরাট সম্পত্তিও কুনবেরের হাতে ছিল না যা বন্ধক দিয়ে টাকা আনতে পারতেন। এইসময় বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়দের কাছেই ধারের জন্য হাত পাততে হয়েছিল তাঁকে। কুনবের বললেন,” একটা সময় ছিল যখন ঋণদাতাদের সময়ে টাকা শোধ দিতে পারতাম না। কিন্তু পালিয়ে যেতাম না। তাদের মুখোমুখি হয়ে সময় আর একটু বাড়ানোর অনুরোধ করতাম। আসলে এটা খুবই জরুরি”। পরে অবশ্য এর দাম পান কুনবের। ২০০৬ সালে তাঁর কোম্পানিতে লগ্নি করতে এগিয়ে আসে রিলায়েন্স পাওয়ার ফান্ড।
সূর্যের হাতছানি
একসময় চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। এখন কিন্তু কুনবের মনে করেন উদ্যোগপতি হওয়াটাই সম্ভবত তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত ছিল।তা তিনি বলতেই পারেন। বিশ্বের ৯০টি দেশে এখন ছড়িয়ে গিয়েছে সু-কম। প্রত্যেকটা দিনই নতুন-নতুন চ্যালেঞ্জ। অসংখ্য কর্মচারী। বিশাল অঙ্কের টার্নওভার।
তবে এখানেই শেষ নয়। আগামীদিনে ভারতে সৌর বিপ্লব ঘটাতে চান তিনি। যেখানে প্রত্যেকটি বাড়িতে সৌরশক্তির ব্যবহার হবে। ভারতে এর একটা বিশাল বাজার দেখতে পাচ্ছেন কুনবের। আর তরুণ উদ্যোগপতি? হ্যাঁ, তাদের দিকেও হাত বাড়াতে চান। ইতিমধ্যেই সোলার এলইডি লাইট নিয়ে কাজ করা হায়দরাবাদের একটি স্টার্টআপকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে তাঁর সংস্থা।
তথ্যসুত্র:ইন্টারনেট