">
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক আগেই যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প পরিবার হাবিব গ্রুপ। ১৯৪৭ সালে ট্রেডিং কম্পানি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আমদানিনির্ভর ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সিমেন্ট শিল্প, জাহাজ ভাঙা, টেক্সটাইল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, ব্যাংকিং ব্যবসা থেকে শুরু করে এই গ্রুপের সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এয়ারলাইনস ব্যবসা। এই ব্যবসার হাল ধরেছে নতুন প্রজন্ম।
৭১ বছর বয়সী এই শিল্প গ্রুপটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে ব্যবসায়ী হাবিব উল্লাহ মিয়ার ট্রেডিং কম্পানি দিয়ে। তখন হাবিব ট্রেডিং শুধু আমদানি এবং তুলা রপ্তানির ব্যবসা করত। ইউরোপে একচেটিয়া তুলা রপ্তানির জন্য তারা বেশ সফলতা অর্জন করেছিল। পাকিস্তান আমলে যেসব বনেদি গ্রুপ ব্যবসা করত হাবিব মিয়া তাদের প্রায় সমবয়সী।
উত্তরাধিকার সূত্রেই হাবিব উল্লাহ মিয়া ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। তাঁর বাবা নজু মিয়া সওদাগর ছিলেন চট্টগ্রামের একজন প্রতিথযশা ব্যবসায়ী; ছিলেন আসাম-বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট। চট্টগ্রামে তাঁর নামে সড়ক ও বাজার রয়েছে।
ট্রেডিং ব্যবসা দিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন ২০টি শিল্প ইউনিটে বার্ষিক ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করছে হাবিব গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। ব্যবসার আকার এত বড় হলেও এই শিল্প গ্রুপ প্রচারের মধ্যে নেই। হাবিব গ্রুপের ব্যবসা শুরু, পরিধি বাড়ানো, নতুন বিনিয়োগ এবং ব্যবসার বৈচিত্র্য বাড়ানো সব কিছুই হয়েছে চট্টগ্রামকে ঘিরেই।
ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের মতো চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়নি হাবিব গ্রুপ। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, ঐতিহ্য ধারণ করেই সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করছে। এ প্রসঙ্গে গ্রুপের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই লড়াই আমরা এখনো করছি ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে।’
তিনি জানান হাবিব গ্রুপের নীতি হচ্ছে, পণ্যের মান ও সেবা ঠিক রেখে ক্রেতার আস্থা অর্জনের মাধ্যমে বাজারে চিরস্থায়ী অবস্থানে থাকা। তাঁর প্রতিষ্ঠান অধিক মুনাফা এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লোভে দৌড়ায় না, ব্যবসাটা বুঝে-শুনে করে।
১৯৮১ সালে হাবিব মিয়ার মৃত্যুর পর গ্রুপের হাল ধরেন তিন সন্তান ইয়াকুব আলী, মাহবুব আলী ও ইয়াসিন আলী। এর মধ্যে ব্যবসায়ী মহলে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মাহবুব আলী। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে। ব্যবসার বৈচিত্র্য শুরু হয় তাঁর এবং ছোট ভাই ইয়াসিন আলীর হাত ধরেই।
টেক্সটাইল থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ এবং এয়ারলাইনস ব্যবসাও তাঁর পরিকল্পনাতেই হয়; কিন্তু এয়ারলাইনস ব্যবসা তিনি শুরু করে যেতে পারেননি।এ বিষয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, ছোট ভাই মাহবুব আলী ও ইয়াসিন আলীর বড় স্বপ্ন ছিল এয়ারলাইনস ব্যবসা করার। এ জন্য বিমান কেনা থেকে শুরু করে রিজেন্ট এয়ারলাইনস নামকরণ এবং লোকবল নিয়োগ সবই চূড়ান্ত হয়; কিন্তু তার অকাল মৃত্যু এয়ারলাইনস শুরুটা দেখে যেতে পারেনি।
তার ইচ্ছাকে সম্মান দিতে বিশেষ ব্যবস্থায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দর রাতে খোলা রেখেই রিজেন্টের উড়োজাহাজেই মরদেহ আনা হয়।বাবার ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশের কারণ জানতে চাইলে ইয়াকুব আলী বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় দ্রুত উত্থান-পতন ঘটে। আমরা তা চাইনি। এ জন্য অন্য ব্যবসায় মনোযোগ দিই।’
তিনি বলেন, আগে দেখেছি খাতুনগঞ্জে ব্যবসা বন্ধ হতো রাত ১১টায়, জমজমাট ছিল লেনদেন। এখন দিনের বেলায়ও সাঁই সাঁই করে গাড়ি ঢুকছে খাতুনগঞ্জে। শুধু খাতুনগঞ্জের ব্যবসা নয়, সব কিছুই তো ঢাকায় চলে যাচ্ছে।
ইয়াকুব আলী মনে করেন, সব সুযোগ-সুবিধা ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় বাধ্য হয়ে সব প্রধান কার্যালয় সেখানে স্থানান্তর করছেন ব্যবসায়ীরা।
বহুজাতিক লিভার ব্রাদার্স থেকে শুরু করে বনেদি শিল্প গ্রুপগুলো চট্টগ্রাম থেকে প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নিলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে হাবিব গ্রুপ। তাদের করপোরেট অফিস এখনো চট্টগ্রামের জুবিলি রোডের লাভ লেইন এলাকায়। এই শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, কঠিন সংগ্রাম করছি এবং সফলভাবে মোকাবেলা করছি। কারণ আমাদের দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে।
ইয়াকুব আলী বলেন, এয়ারলাইনসের পর আমরা জ্বালানি খাতে ব্যবসা শুরু করি। প্রথমে নিজেদের কারখানার প্রয়োজনে ছোট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করি। পরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে সম্পৃক্ত হই। এখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড আর নরসিংদীর ঘোড়াশালে স্থাপিত দুটি বিদ্যুেকন্দ্র থেকে উৎপাদন ১৪১ মেগাওয়াট। যার ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
দেশের প্রথম সারির এনসিসি ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার হাবিব গ্রুপ। শুরুর দিকের অনুভূতি বলতে গিয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, প্রথমে এটি ছিল ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি। এক বন্ধুর কাছ থেকে কিনে দুঃখে পড়ি। সে সময় নিজের পকেটের টাকায় বিমানে মিটিংয়ে যোগদানের জন্য ঢাকা গেছি, ডিভিডেন্ট তো দূরে থাক গাড়ি ভাড়া, খাওয়ার টাকাও পাইনি। অনেক প্রতিকূলতার পর আজ এনসিসি ব্যাংক বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে।
এনসিসি ছাড়াও মেঘনা ব্যাংক, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স কম্পানি, কন্টিনেন্টাল ইনস্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স ও যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানিরও অন্যতম অংশীদার হাবিব গ্রুপ। এ ছাড়া নিজেদের আছে চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত শেয়ার ও সিকিউরিটিজ কম্পানি।
ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের অন্যতম অংশীদার হাবিব গ্রুপ। ইয়াকুব আলী বলেন, ১৯৯৬ সালে যাত্রার দিনে ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে যাত্রা শুরু। আজ তিনটি ইউনিটে দিনে উৎপাদন হয় প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট। ভারত ও মিয়ানমারে রপ্তানিও করছি।
বর্তমানে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল কারখানা হচ্ছে হাবিব গ্রুপের। সেটি আরো সম্প্রসারণ হচ্ছে জানিয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, টেক্সটাইলের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানির বদলে আমরা চট্টগ্রাম থেকেই সরবরাহের চিন্তা রেখেই কারখানা সম্প্রসারণ হচ্ছে।
হাবিব গ্রুপ যশোরে এসএসপি সার কারখানা স্থাপন করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে স্থাপিত এই কারখানা থেকে বছরে ১ লাখ ৩৫ হাজার টন এসএসপি সার উৎপাদিত হচ্ছে। আর জাহাজভাঙাশিল্পের চারটি ইয়ার্ডে বছরে ২ লাখ টন স্ক্র্যাপ তৈরি হচ্ছে।
গ্রুপের অংশীদারিত্বের ৫০০ বেডের একটি হাসপাতালে কম্পানির ২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবার বিনা মূল্য চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করেছে হাবিব গ্রুপ।
কোন ব্যবসায় মনোযোগ বেশি জানতে চাইলে ইয়াকুব আলী বলেন, ‘নাম-যশ খ্যাতির জন্য এয়ারলাইনস, মানুষ এক নামেই চেনে। কিন্তু সামান্য ঘটনার জন্য বদনামও কম হয় না।
নতুন প্রজন্মের কাজের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত নতুন প্রজন্ম অবশ্যই আমাদের চেয়ে ভালো করবে। কারণ তারা বিশ্বের সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত এবং ব্যবসার সর্বশেষ ও ভালো ধারণা রাখে। ব্যবসায় টিকে থাকতে এখন সবাই প্রযুক্তির দিকে নজর দিচ্ছে।
বর্তমানে হাবিব গ্রুপের হাল ধরছে তৃতীয় প্রজন্ম। রিজেন্ট এয়ারলাইনস দেখছেন মাশরুফ হাবিব, টেক্সটাইল খাতের হাল ধরছেন সালমান হাবিব আর গার্মেন্টসের হাল ধরছেন তানভীর হাবিব। তাঁরা তিনজনই গ্রুপ পরিচালক। এ ছাড়া রিজেন্ট এয়ারের পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন তানজিলা হাবিব।
ইয়াকুব আলী ছাড়াও গ্রুপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও নীতিনির্ধারণী কাজ করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসীন আলী।একটি দেশি কমপ্লায়েন্স কম্পানি; কিন্তু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গ্রুপ হিসেবে প্রতিষ্ঠাই কম্পানির মূল লক্ষ্য বলে জানালেন ইয়াকুব আলী।
৬৭ বছর বয়সী ইয়াকুব আলী এখনো প্রতিদিন সময় মেনে অফিসে এসে কাজ সারেন, নীতিনির্ধারণী পরামর্শ দেন। জরুরি কাজ না থাকলেও অফিসে আসেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে ব্যবসায়ীদের কোনো অবসর নেই। স্যামসন এইচ চৌধুরীও জীবনের শেষদিনও অফিস করেছেন। আমি খুবই এনজয় করি অফিসে। বাসায় থাকলে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই।
আসিফ সিদ্দিকী
তথ্যসূত্র: কালের কন্ঠ ডটকম।